রাবণের চিতা - সুকুমার রায়

লোকে বলে রাবণের চিতায় যে আগুন দেওয়া হয়েছিল সে আগুন নাকি এখনও নিভান হয়নি—এখনও তা জ্বলছে। কোথায় গেলে সে আগুন দেখা যায় তা আমি জানি না—কিন্তু এম...

লোকে বলে রাবণের চিতায় যে আগুন দেওয়া হয়েছিল সে আগুন নাকি এখনও নিভান হয়নি—এখনও তা জ্বলছে। কোথায় গেলে সে আগুন দেখা যায় তা আমি জানি না—কিন্তু এমন আগুন দেখা গেছে যা বছরের পর বছর ক্রমাগতই জ্বলছে; মানুষ তাতে জল ঢেলে মাটি চাপা দিয়ে নানারকমে চেষ্টা করেও তাকে নিভাতে পারেনি।

খনি থেকে কয়লা এনে সেই কয়লা দিয়ে লোকে আগুন জ্বালায়। কিন্তু তা না করে যদি একেবারে খনির মধ্যেই আগুন ধরিয়ে খনিকে খনি জ্বালিয়ে দেওয়া যায় তবে কিরকম হয়? বাস্তবিকই এমন সব কয়লার খনি আছে যার আশেপাশে বারো মাসই আগুন জ্বলে। সেসব খনির লোকেরা সব সময়ে ভয়ে ভয়ে থাকে—কখন সে আগুন খনির মধ্যে এসে পড়ে। কোনদিকে যদি খনির দেয়াল একটু গরম হয় কিংবা খনির কাছে কোন জায়গা যদি বসে-যাবার মতো হয়, তবেই হৈচৈ লেগে যায়—'আগুন আসছে, আগুন আসছে'। খনির একদল লোক আছে তাদের কাজ কেবল আগুন তাড়ান। যেদিক দিয়ে আগুন আসছে বোধ হয়, তারা সেইদিকে ইঁট পাথরের দেয়াল তুলে আগুনের পথ বন্ধ করে দেয়। আগুন তখন বাধ্য হয়ে আর কোন দিক ঠেলে তার পথ করে নেয়। কেমন করে কোথা হতে আগুন আসে তা সব সময়ে বলা যায় না। মাটির নিচে হয়ত বিশ পঁচিশ মাইল জায়গা জুড়ে কয়লার স্তর রয়েছে—কোথাও ১০০ হাত, কোথাও হয়ত পাঁচ হাত মাত্র পুরু। তারই কোনখানে যদি কোন গতিকে আগুন ধরে আর তার আশেপাশে পাহাড়ের ফাটলে যদি বাতাস যথেষ্ট থাকে—তবে সে আগুন একেবারে 'রাবণের চিতা' হয়ে দাঁড়ায়।

খোলা বাতাসে কয়লা যেমন ধূ ধূ করে জ্বলে যায়, মাটির নিচে তেমন হয় না—সেখানে আগুন যেন শামুকের মতো আস্তে আস্তে হামাগুড়ি দিয়ে চলতে থাকে। যেদিকে তার পথ খোলা, যেদিকে একটু কয়লা আর বাতাস—আগুন একদিনে হোক এক বছরে হোক সেদিকটা দখল করবেই। অনেক দিন আগে একবার ইংলন্ডের একটা গির্জা হঠাৎ বসে যেতে আরম্ভ করল—তার দেয়াল মেঝে সব দেখতে দেখতে হাঁ করে উঠল। এঞ্জিনিয়ার এসে মাটি খুঁড়ে দেখেন ১২ হাত নিচেই কয়লার স্তর আর তাতে আগুন লেগেছে—কয়লা যতই পুড়ে যাচ্ছে, উপরের মাটিও ততই ধ্বসে পড়ছে। তখন পরামর্শ করে সকলে গির্জার মেঝেটা খুঁড়ে প্রকাণ্ড একটা ফুটো করলেন। সেই ফুটোর মধ্যে প্রায় এক পুকুর জল ঢেলে দেওয়া হল—তারপর মাটি খুঁড়ে লোহার শিক বসিয়ে তার নিচে দেয়ালের গায়ে দেয়াল তুলে সবাই ভাবল, 'এবারে আগুন জব্দ হয়েছে।' কিন্তু সাতাশ বৎসর পরে আবার সেই আগুন কয়লা পুড়িয়ে পুড়িয়ে তিন দিক ঘুরে গির্জার পিছনে এসে হাজির।

অনেকদিন আগে লিভারপুলের কাছে টড্‌ নদীর ধারে এক কয়লার খনি ছিল। হঠাৎ কেমন করে সেই খনির এক কোণে আগুন লেগে যায়। খনিশুদ্ধ লোক প্রাণপণ চেষ্টা করেও যখন সে আগুন নিভান গেল না, তখন খনির কর্তারা খাল কাটিয়ে টড্‌ নদীকে খনির মধ্যে ছেড়ে দিলেন। তাতে তখনকার মতো আগুন চাপা পড়ল বটে কিন্তু জলের স্রোত খনির এমন দুরবস্থা করল যে কর্তারা ভয় পেয়ে গেলেন। তারপর যখন কিছুদিন না যেতেই আগুন আবার আর একদিকে এসে উঁকি মারল তখন সকলেই বললেন আগুন নিভাবার চেষ্টা বৃথা—ওকে কোনরকমে ঠেকিয়ে রাখ। যেদিকে আগুন আসবার ভয় সেদিকের কয়লা সরিয়ে ফেল, বড় বড় খাল কেটে দেয়াল তুলে, পথ বন্ধ কর। তাহলেই আগুন আর ছড়াতে পারবে না—ক'দিন বাদে আপনি নিভে যাবে। এইরকমে ছাব্বিশ বছর আগুনের সঙ্গে যুদ্ধ চলল। একদল লোক কেবল ওই কাজেই দিন রাত লেগে রইল; যারা ছোট ছিল তারা প্রায় বুড়ো হয়ে এল; খনির পাশে দেয়ালের পর দেয়াল উঠল, আগুনের উপর নিচে চারদিকে ঘেরাও হয়ে গেল—কিন্তু আগুন কি থামতে চায়! দেয়াল ভেঙে, পাথর ফাটিয়ে আগুনের শিখা বারবার দেখা দিতে লাগল; আগুন বেড়েই চলল।

একদিকে যেমন আগুন, আর একদিকে জল! পাহাড়ের ফাটল দিয়ে টড্‌ নদীর জল এসে খনির মধ্যে দিনরাত পড়ত—সেই জল পাম্পকল দিয়ে ক্রমাগত বাইরে ফেলে দিতে হয়। একদিন টড্‌ নদীতে জোয়ার লেগে উপরের মাটি ধসে গিয়ে কবেকার পুরান এক সুড়ঙ্গের মধ্য দিয়ে খনির ভিতরে হু হু করে জল ঢুকল। ভাগ্যিস তখন খনির মধ্যে লোক ছিল না, গোলমাল শুনে তারা সকলে খনির মুখের কাছে দৌড়ে এল। ব্যাপারটা কি বুঝতে কারও বাকী রইল না; সকলেই বলতে লাগল এই জল যদি আগুনে গিয়ে পড়ে, তবে কি হবে? আগুনে জলে যখন দেখা হল তখন কয়েক মিনিট ধরে একটা ভয়ানক গর্জন আর যুদ্ধ চলল—ফুটন্ত জল ফোয়ারার মতো দুশ হাত উঁচু হয়ে এমন জোরে ছুটে বেরুল যে তার ধাক্কায় খনির মুখের কলকব্জা সব কোথায় উড়ে গেল। তারপর দেখতে দেখতে সব চুপচাপ! আগুন ঠাণ্ডা হল আর সঙ্গে সঙ্গে খনির দফাও ঠাণ্ডা।

COMMENTS

Name

Bangla Moral,3,Health,6,Humor,2,Inspiration,95,Moral Stories,18,Quote Index,7,Reading for pleasure,1,Tips and Tricks,5,গল্প - সুকুমার রায়,23,ছড়া - সুকুমার রায়,1,জীবজন্তু - সুকুমার রায়,36,বিবিধ - সুকুমার রায়,8,হাসির গল্প,2,
ltr
item
Quote Index: রাবণের চিতা - সুকুমার রায়
রাবণের চিতা - সুকুমার রায়
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEiIMlGY1fzS5FID8MzHFwcJkAg_kuufURrQDdkTuhPSO0Ec_uajGKQnL6bCKsT01QVnweLy2QMQsBOrlQsFtUEuhijPtKcAF_JP1QiEtNf-t6EWs8eWg_bzVyWcXlCsPd68WLL4e8jOLnE/s1600/default_jana-ajana.png
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEiIMlGY1fzS5FID8MzHFwcJkAg_kuufURrQDdkTuhPSO0Ec_uajGKQnL6bCKsT01QVnweLy2QMQsBOrlQsFtUEuhijPtKcAF_JP1QiEtNf-t6EWs8eWg_bzVyWcXlCsPd68WLL4e8jOLnE/s72-c/default_jana-ajana.png
Quote Index
https://quoteindex.blogspot.com/2016/07/blog-post.html
https://quoteindex.blogspot.com/
http://quoteindex.blogspot.com/
http://quoteindex.blogspot.com/2016/07/blog-post.html
true
4124448561539239466
UTF-8
Loaded All Posts Not found any posts VIEW ALL Readmore Reply Cancel reply Delete By Home PAGES POSTS View All RECOMMENDED FOR YOU LABEL ARCHIVE SEARCH ALL POSTS Not found any post match with your request Back Home Sunday Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday Saturday Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat January February March April May June July August September October November December Jan Feb Mar Apr May Jun Jul Aug Sep Oct Nov Dec just now 1 minute ago $$1$$ minutes ago 1 hour ago $$1$$ hours ago Yesterday $$1$$ days ago $$1$$ weeks ago more than 5 weeks ago Followers Follow THIS PREMIUM CONTENT IS LOCKED STEP 1: Share to a social network STEP 2: Click the link on your social network Copy All Code Select All Code All codes were copied to your clipboard Can not copy the codes / texts, please press [CTRL]+[C] (or CMD+C with Mac) to copy Table of Content