সূর্যের কথা - সুকুমার রায়

সূর্যটা একটা গোল আগুনের পিণ্ড, এ কথা আমরা সকলেই জানি। গোল, সেটা চোখেই দেখতে পারি—আর 'আগুন' কিনা তা একটিবার দুপুর রোদে দাঁড়ালেই আর বু...

সূর্যটা একটা গোল আগুনের পিণ্ড, এ কথা আমরা সকলেই জানি। গোল, সেটা চোখেই দেখতে পারি—আর 'আগুন' কিনা তা একটিবার দুপুর রোদে দাঁড়ালেই আর বুঝতে দেরি লাগে না। পণ্ডিতেরা বলেন, এই পৃথিবীটার মতো তেরো লক্ষ পিণ্ডের তাল পাকালে তবে এই সূর্যের সমান বড় হয়। তাঁরা কেমন করে জানলেন? যাঁরা জরিপ করেন তাঁরা জানেন, খুব দূরের জিনিসকে নানারকমে পরখ করে এমন হিসাব পাওয়া যায় যা থেকে চট্‌ করে বলা যায় যে জিনিসটা কতখানি দূরে! এই কৌশলটি পণ্ডিতেরা সূর্যের উপর খাটিয়েছেন। পৃথিবীর দুই জায়গায় দুইজন লোক বসে সূর্যটাকে খুব সূক্ষ্মভাবে পরীক্ষা করে দেখেছেন, কোন্‌ সময়ে সেটাকে আকাশের ঠিক কোন্‌ জায়গায় দেখা যায়—এবং দুজনের হিসাব মিলিয়ে অঙ্ক কষে বলেছেন যে সূর্যটা এখান থেকে নয় কোটি ত্রিশ লক্ষ মাইল দূরে। সে যে কতদূর তা আমাদের কল্পনাতেই আসে না। একটা এঞ্জিন যদি ঘণ্টায় ৬০ মাইল করে ক্রমাগত ছুটে আজ থেকে সূর্যের দিকে রওনা হয়, সে ১৭৭ বছর পরে (২০৯৩ খৃষ্টাব্দে) সূর্যে গিয়ে পৌঁছবে। পণ্ডিতেরা এইসকল মাপ নিয়ে বলেছেন যে ঐ সূর্যের পাশে পৃথিবীটাকে বসালে সেটা দেখাবে যেন একটি তরমুজের পাশে একটি মুসুরির ডাল।

সূর্যটা কিসের তৈরি? সূর্যের আলোক পরীক্ষা করে পণ্ডিতেরা বলেন যে, পৃথিবীটা যা দিয়ে তৈরি সূর্যটাও ঠিক তাই দিয়েই তৈরি। তবে, সেইসব মাল-মসলা জমে এখানে যেমন জল মাটি পাথর হয়েছে সেখানে তা হবার যো নেই—কারণ, সেখানকার সর্বনেশে গরমে সব জিনিস সত্য সত্যই আগুন হয়ে ওঠে। লোহা শুধু গলে যায় তা নয়, ফুটন্ত জলের মতো টগ্‌বগ্‌ করে বাষ্প হয়ে উড়ে যায়। এই ফুটন্ত আগুন আর জ্বলন্ত বাষ্প সূর্যের চারিদিক ঘিরে লক্‌লক্‌ করতে থাকে। শুধু চোখে মনে হয় সূর্যটা একটি মোলায়েম গোল জিনিস, তার গায়ে কোথাও আঁচড়ের দাগটি পর্যন্ত নেই। কিন্তু আসলে তা নয়। ভাল দূরবীন দিয়ে দেখলে বোঝা যায় যে, তার সমস্ত গা ভরে আগুনের চিক্‌মিক্‌ খেলছে—আগুনের সমুদ্রে আগুনের ঢেউ, তার মধ্যে বড় বড় আগুনের ডেলা পাগলের মতো ডুবছে আর ভাসছে। তাছাড়া সূর্যের গায়ে প্রায়ই ছোট বড় ফোসকা দেখা যায়—ফোসকাগুলি তত উজ্জ্বল নয়, তাই দেখতে হঠাৎ কালো দেখায়। জলের মধ্যে যেমন বুদবুদ ওঠে সূর্যের গায়ে তেমনি আগুনের ফোসকা ওঠে আর ফেটে পড়ে। এক একটি বুদবুদ মাঝে মাঝে এত বড় হয় যে, কালো কাচ দিয়ে দেখলে সেগুলোকে শুধু চোখেই দেখতে পার। ঐরকম এক একটা বুদবুদের মধ্যে ইচ্ছে করলে, দু-দশটা পৃথিবীকে স্বচ্ছন্দে পুরে রাখা যায়। ঐ ফোসকাগুলি এক একটি আগুনের ঘূর্ণিচক্র, তার চারিদকে দম্‌কা আগুন ঠেলে উঠছে।

সূর্যের তেজ এত বেশি যে তার চারিদকে যে আগুনের শিখা ঝড়ের মতো উঠছে আর পড়ছে, সেগুলি আমরা দেখতেই পাই না। সূর্যের যখন পূর্ণগ্রহণ হয়, চাঁদটা মাঝে পড়ে তার চক্‌চকে শরীরটা আড়াল করে ফেলে, তখন তাদের চেহারা দেখা যায় আগুনের লক্‌লকে জিভের মতো। শিখাগুলি হাজার হাজার মাইল জুড়ে দপ্‌ দপ্‌ করে জ্বলতে থাকে, কখন আগুনের ঝাপটা দিয়ে মিনিটে ছয় হাজার মাইল ছুটে যায়, কখন শান্ত মেঘের মতো সূর্যের গায়ে ভেসে বেড়ায়। এক একটাকে দেখে মনে হয় যেন আগুনের ফোয়ারা উঠছে। তার মধ্যে যদি আমাদের এই পৃথিবীটাকে ছেড়ে দাও একটি চক্ষের নিমেষে গলে বাষ্প হয়ে কোথায় যে মিলিয়ে যাবে সে আর খুঁজেই পাবে না। সূর্যের চারিদিকের এই অগ্নিমেঘের স্তরটিকে দিনের আলোতে দেখবার জন্য পণ্ডিতেরা আশ্চর্যরকম উপায় বার করেছেন, তার জন্য তাঁদের এখন আর গ্রহণের অপেক্ষায় বসে থাকতে হয় না।

কিন্তু সূর্যের চারিদিকে আরে একটি জিনিস আছে যেটিকে গ্রহণ ছাড়া দেখবার যো নেই—সেটিকে সূর্যের কিরীট (Corona) বলা যায়। পৃথিবীর চারিদিকে যেমন বাতাসের আবরণ সূর্যের চারিদিকেও তেমনি বহুদূর পর্যন্ত এই কিরীটের ঢাকনি। যাঁরা সূর্যের পূর্ণগ্রহণ দেখেছেন তাঁরা বলেন, এমন আশ্চর্য অদ্ভুত দৃশ্য আর কিছু নেই। যখন গ্রহণ সম্পূর্ণ হয়ে আসতে থাকে, চাঁদের কালো ছায়া যখন চোখের সামনে পাহাড় সমুদ্র সব গ্রাস করে ফেলতে থাকে, আকাশের অদ্ভুত ফ্যাকাসে রং আর পৃথিবীর অন্ধকার দেখে, পশু পাখি পর্যন্ত ভয়ে স্তব্ধ হয়ে যায়; সেই সময়ে সূর্যের তেজ চাপা পড়ে তার আশ্চর্য কিরীটের শোভা দেখা যায়। শুধু এই কিরীটের সুন্দর স্নিগ্ধ আলো দেখবার জন্যই কত লোকে পয়সাকড়ি খরচ করে হাজার হাজার মাইল পার হয়ে গ্রহণ দেখতে যায়। এই কিরীটের চেহারা সব সময়ে এক রকমের থাকে না—কখন সেটা চারিদিকে বেশ সমানভাবে গোল হয়ে থাকে, কখন তার মধ্যে ভয়ানক ঝড় ঝাপটার লক্ষণ দেখা যায়—কখন তা থেকে লম্বা লম্বা ছটা বেরিয়ে অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। মোটের উপর বলা যায়, যে সময়ে সূর্যের গায়ে ফোসকা বেশি দেখা যায় সেই সময়ে তার আগুনের শিখাগুলিরও অত্যাচার বাড়ে, আর সেই অত্যাচারে তার কিরীটটিকেও ঘাঁটিয়ে তোলপাড় করে তোলে। আমরা জানি যে পৃথিবীটা ২৪ ঘণ্টায় একবার পাক খায়, তাতেই আমাদের দিনরাত হয়। সূর্যটাকে পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে সেও ভয়ংকর বেগে লাট্টুর মতো ক্রমাগত পাক খাচ্ছে—কিন্তু একটি পাক খেতে তার ছাব্বিশ দিন সময় লাগে।

অনেকের বিশ্বাস এই যে, সূর্যটা এক জায়গায় স্থির হয়ে বসে আছে—কিন্তু পৃথিবী গ্রহ চন্দ্র সবাই মিলে ঘুরতে ঘুরতে তার চারিদিক প্রদক্ষিণ করছে। কিন্তু আসলে তা নয়—বিশ্বজগতে কারও স্থির হয়ে বসে থাকবার হুকুম নেই। আমাদের এই পৃথিবী এবং আর সমস্ত গ্রহকে নিয়ে সূর্য ভয়ানক বেগে শূন্যে ছুটে চলেছে। সে কোন্‌দিকে কিরকম বেগে চলছে, তাও পণ্ডিতেরা হিসাব করে ঠিক করেছেন। এই হিসাবে সূর্য ঘণ্টায় প্রায় কুড়ি হাজার মাইল পথ ছুটে চলেছে।

শুনলে হঠাৎ হয়তো মনে হতে পারে, এমন সাংঘাতিক চলতে গিয়ে হয়ত কোন্‌দিন কোন্‌ তারার সঙ্গে তার ঢুঁ লেগে যাবে—কিন্তু সেরকম ভয়ের কোন কারণ নেই। এইসব তারাগুলি এক একটি এত দূরে যে সূর্যটা দশ লক্ষ বৎসর এইভাবে ছুটলেও কোন তারার কাছে পৌঁছাবার সম্ভাবনা নেই। তোমরা হিসাব করে দেখ—এক ঘণ্টায় যদি ২০০০০ মাইল যাওয়া যায় তাহলে দশ লক্ষ বৎসরে কত মাইল? ২০০০০ × ২৪ × ৩৬৫ × ১০০০০০০ । তাহলে এক একটি তারা কতখানি দূরে একবার ভাবতে চেষ্টা কর।

COMMENTS

Name

Bangla Moral,3,Health,6,Humor,2,Inspiration,95,Moral Stories,18,Quote Index,7,Reading for pleasure,1,Tips and Tricks,5,গল্প - সুকুমার রায়,23,ছড়া - সুকুমার রায়,1,জীবজন্তু - সুকুমার রায়,36,বিবিধ - সুকুমার রায়,8,হাসির গল্প,2,
ltr
item
Quote Index: সূর্যের কথা - সুকুমার রায়
সূর্যের কথা - সুকুমার রায়
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEjloY3uXJlC-3ChcVS4KJfzPmXIXZi3WVcPMjf6QDdpZZ4kaCLe0lykQU1GTDv_rQ8q-br24zCidluInp6-t6kHP1W9DFXMA7IhHpSD0okf8adKWutzd9HqZ23xyI_STsinQyoDMJTNgU4/s1600/default_jana-ajana.png
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEjloY3uXJlC-3ChcVS4KJfzPmXIXZi3WVcPMjf6QDdpZZ4kaCLe0lykQU1GTDv_rQ8q-br24zCidluInp6-t6kHP1W9DFXMA7IhHpSD0okf8adKWutzd9HqZ23xyI_STsinQyoDMJTNgU4/s72-c/default_jana-ajana.png
Quote Index
https://quoteindex.blogspot.com/2016/07/blog-post_29.html
https://quoteindex.blogspot.com/
http://quoteindex.blogspot.com/
http://quoteindex.blogspot.com/2016/07/blog-post_29.html
true
4124448561539239466
UTF-8
Loaded All Posts Not found any posts VIEW ALL Readmore Reply Cancel reply Delete By Home PAGES POSTS View All RECOMMENDED FOR YOU LABEL ARCHIVE SEARCH ALL POSTS Not found any post match with your request Back Home Sunday Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday Saturday Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat January February March April May June July August September October November December Jan Feb Mar Apr May Jun Jul Aug Sep Oct Nov Dec just now 1 minute ago $$1$$ minutes ago 1 hour ago $$1$$ hours ago Yesterday $$1$$ days ago $$1$$ weeks ago more than 5 weeks ago Followers Follow THIS PREMIUM CONTENT IS LOCKED STEP 1: Share to a social network STEP 2: Click the link on your social network Copy All Code Select All Code All codes were copied to your clipboard Can not copy the codes / texts, please press [CTRL]+[C] (or CMD+C with Mac) to copy Table of Content