প্রলয়ের ভয় - সুকুমার রায়

পুরাণে আমরা প্রলয়ের কথা পড়েছি। কবে প্রলয় হয়েছিল, আবার কবে হবে, কেমন করে প্রলয় হয়, এইসবের নানারকম বর্ণনাও তাতে আছে। প্রলয়ের সময়ে সমস্ত সৃষ্টি...

পুরাণে আমরা প্রলয়ের কথা পড়েছি। কবে প্রলয় হয়েছিল, আবার কবে হবে, কেমন করে প্রলয় হয়, এইসবের নানারকম বর্ণনাও তাতে আছে। প্রলয়ের সময়ে সমস্ত সৃষ্টি যে জলে ডুবে যাবে এ কথাও বার বার করে বলা হয়েছে। আশ্চর্য এই যে, নানান দেশে নানান জাতির ইতিহাসে প্রলয়ের প্রায় একই ধরনের বর্ণনা আছে। অন্তত এ কথাটা অনেক দেশের পুরাণেরি শোনা যায় যে, একবার প্রলয় হয়ে এই পৃথিবীটা ডুবে গেছিল। তাতে সমস্ত জীবজন্তু প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়। পণ্ডিতেরা বলেন, এ কথাটার মধ্যে একটুখানি সত্যিকারের ইতিহাস আছে। যাঁরা ভূতত্ত্ববিদ্‌ অর্থাৎ যাঁরা পাথর পাহাড় ঘেঁটেঘুঁটে পৃথিবীর পুরান কথার সংবাদ নিয়ে ফেরেন তাঁরা বলেন যে, মানুষের জীবনে বড় বড় রোগের মতো পৃথিবীর জীবনেও এক একটা বড় বড় 'সংকট যুগ' দেখা গিয়েছে। যুগে যুগে বড় বড় দেশের জলবায়ুর পরিবর্তন হয়েছে, গ্রীষ্মের দেশ হিমের হাওয়ায় বরফে ঢেকে গিয়েছে, আর দুরন্ত শীতের দেশে বরফ ঠেলে সবুজ ঘাস আর বনজঙ্গল দেখা দিয়েছে। যেখানে দেশ ছিল সেখানে কত সাগর হয়েছে—আবার, কত কত সাগর ফুঁড়ে নতুন দেশ মাথা তুলেছে। আর, মাঝে মাঝে এক একটা বন্যা এসে পাহাড় ধুয়ে পৃথিবী ধুয়ে দেশকে দেশ সাফ করে দিয়েছে। এইরকম ছোট বড় কত প্রলয় এই পৃথিবীর উপর দিয়ে চলে গিয়েছে—আমরা এখনও পুরাণের মধ্যে, গল্পের মধ্যে তারই একটু আভাস পাই, আর পাহাড় পর্বতে পাথরের স্তরে তার নানারকম পরিচয় দেখি।

একজন জ্যোতির্বিদ পণ্ডিত এক বক্তৃতায় বলেছিলেন যে, "এই যে সূর্য, এ চিরকাল এমন থাকবে না। একদিন এরও তেজ ফুরিয়ে যাবে—এ-ও তখন নিভে যাবে।" এই কথা শুনে একজন ভীতু-গোছের ভদ্রলোক তাঁকে চিঠি লেখেন যে, "মহাশয়, আপনি যেরকম বিপদের কথা বললেন তা শুনে আমার বড় ভয় হয়েছে। সেরকম প্রলয়টা কবে হবে, আর আমার ছেলেপিলেদের জন্য তা হলে কিরকম ব্যবস্থা করলে তারা বাঁচতে পারে—আমায় একটু জানাবেন কি?" জ্যোতির্বিদ পণ্ডিত এর উত্তরে লিখলেন, "আপনার এত ব্যস্ত হবার কারণ নেই—আপনার ছেলেরা যদি লাখ বছরও বেঁচে থাকে, তবু এ সূর্যকে আজ যেমন দেখছে তখনও তেমনই দেখবে—তেজ দুরাতে আরও অনেক দেরি আছে। সুতরাং আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।" লোকে বড় বড় ঝড় বৃষ্টি ভূমিকম্প আগুনের উৎপাত দেখে তা থেকে প্রলয় জিনিসটা কি রকম, তার একটা আন্দাজ করে। বাস্তবিক, ছোটখাট প্রলয় পৃথিবীর উপর দিয়ে সব সময়েই চলেছে। কিন্তু আজ যে প্রলয়ের কথা বলব সেটা কিছু সত্যিকার প্রলয় নয়—লোকে প্রলয়কে হুজুকে যে নানারকম মিথ্যা ভয়ের সৃষ্টি করে, তারই কথা।

অপরিচিত জিনিস দেখলেই তার সম্বন্ধে মানুষের ভয় বিস্ময় বা কৌতূহল জাগ্রত হওয়া স্বাভাবিক। যে জিনিস সর্বদাই দেখতে পাই তাতে মন এমন অভ্যস্ত হয়ে যায় যে সেটাতে আর কোনরকম আশ্চর্য বোধ হয় না। মনে কর, এই সূর্য যদি প্রতিদিন না উঠে হঠাৎ এক-একদিন ঐরকম ভয়ানক আগুনের মতো মূর্তি নিয়ে হাজির হত, তাহলে অধিকাংশ লোকেই যে একটা প্রলয়কাণ্ড হবে মনে করে ভয়ে অস্থির হত তা বুঝতেই পার। চাঁদকেও যদি দু-দশ বছরে ক্বচিৎ এক-আধবার দেখা যেত তবে লোকে না জানি কত আগ্রহ করে কত আশ্চর্য হয়ে তাকে দেখত, আর না জানি সেটা আমাদের চোখে কি সুন্দর লাগত।

ধুমকেতুগুলো যদি মাঝে মাঝে এক-আধটা না এসে ঐ চন্দ্র সূর্যেরই মতো নিতান্ত সাধারণ জিনিস হত, তবে তাদের ঐ ঝাপসা ঝাঁটার মতো চেহারা দেখে ভয় পাবার কোনই কারণ থাকত না। কিন্ত তারা কিনা হঠাৎ কেমন করে খবর না দিয়ে আসে যায়, মানুষের কাছে তাই তাদের এত খাতির! পৃথিবীর প্রায় সকল দেশের লোকেই ধূমকেতুকে একটা অলক্ষণ কিংবা উৎপাত বলে মনে করে। ধূমকেতু যখন আসে তখন আর যা কিছু বিপদ-আপদ সবের জন্যেই ঐ ধূমকেতুকেই লোকে দোষী করে। সে সময়ে রোগ মৃত্যু যুদ্ধ বিদ্রোহ সবই 'ঐ ধূমকেতুর জন্য'। সুতরাং ধূমকেতু এসে পৃথিবী ধ্বংস করবে, এই ভয়টা মানুষের মধ্যে থাকা কিছু আশ্চর্য নয়। পৃথিবীর ইতিহাসে কত বড় বড় দূর্ঘটনাকে যে মানুষ ধূমকেতুর ঘাড়ে চাপিয়েছে তার আর বলে শেষ করা যায় না। নানা দেশের ইতিহাসে নানা সময়কার ধূমকেতুর যেরকম অদ্ভুত ভয়ংকর সব বর্ণনা পাওয়া যায় তাতেই বোঝা যায় যে লোকে তাদের কিরকম ভয়ের চোখে দেখেছে। আমরা ছেলেবেলায় একবার খবরের কাগজে গুজব শুনেছিলাম যে কোথাকার এক 'পাগলা ধূমকেতু' নাকি পৃথিবীর দিকে আসছে—আর কোন্‌ জ্যোতিষী নাকি গুণে দেখেছিলেন যে ঐ ধূমকেতুর ঝাঁটার মতো লেজটা পৃথিবীর উপর এসে পড়বে। ঐ লেজের বাড়ি খেলে পৃথিবীর অবস্থাটা কি হবে তাই নিয়ে কাগজে-পত্রে খানিকটা তর্কবিতর্ক হয়েছিল, কিন্তু সময় হলে দেখা গেল যে তাতে পৃথিবীর ত কিছু হলই না, বরং লেজটাই ছিঁড়ে দু টুকরো হয়ে গেল। সুতরাং ধূমকেতুর ধাক্কা লেগে পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার কল্পনাটা কোন কাজের কল্পনা নয়, কারণ ধূমকেতুর লেজটা এমনই অসম্ভবরকম হালকা যে পৃথিবীর সঙ্গে গুঁতোগুঁতি করতে গেলে তারই বিপদ হবার কথা। তবে পণ্ডিতেরা বলেন যে, পৃথিবীকে কোনদিন যদি কোন ধূমকেতুর মাথাটার ভিতর দিয়ে যেতে হয় তাহলে অবস্থাটা কেমন হবে, ঠিক বলা যায় না। সম্ভবত তখন খুব একটা জমকালো গোছের উল্কাবৃষ্টি হবে।

উল্কাবৃষ্টি জিনিসটা আমি কখন চোখে দেখিনি, কিন্তু তার যে বর্ণনা শুনেছি সে ভারি চমৎকার। আকাশে মাঝে মাঝে তারার মতো এক একটা কি যেন হঠাৎ ছুট দিয়ে কোথায় মিলিয়ে যায়—দেখে লোকে বলে 'তারা খস্‌ল'; কিন্তু আসলে সে তারা নয়—উল্কা। ঐরকম উল্কা যদি মাঝে মাঝে এক-আধটা না হয়ে একেবারে ঝাঁকে ঝাঁকে হাজারে হাজারে আকাশের উপর দিয়ে ছুটে যায়—তখন তাকে বলে 'উল্কাবৃষ্টি'। এর মতো জমকালো ব্যাপার অতি অল্পই আছে। আমরা আকাশে যেসব গ্রহ-নক্ষত্র দেখি তারা সবাই ভাল মানুষের মতো স্থির হয়ে থাকে, তারা ওরকম পাগলের মতো ছুটাছুটি করে না। সুতরাং হাজার হাজার উল্কাকে অমনভাবে ছুটাছুটি করতে দেখলে হঠাৎ মনে কেমন ভয় হয়—যদি দু-চারটা ঘাড়ে এসে পড়ে, তাহলে অবস্থাটা কিরকম হবে। কিন্তু আসলে তেমন ভয় পাবার কিছুই নেই। উল্কাগুলির প্রায় সমস্তই পৃথিবীতে পড়বার ঢের আগেই বাতাসের ঘষায় আপনা হতেই জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। যদি না জ্বলত তবে আমরা তাদের দেখতেই পেতাম না; কারণ, একে তারা অধিকাংশই নিতান্ত ছোট, তার উপর তাদের নিজেদের কোন আলো নেই; কেবল মরবার সময় যখন তারা আপন "বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে নিয়ে" জ্বলে মরে তখন তার সেই শেষ আলোতে আমরা তাদের একটুক্ষণ দেখি মাত্র। যা হোক, ভয়ের কারণ নাই বা থাকুক একেবারে হাজার হাজার উল্কা পৃথিবীর উপর ঝাঁপ দিয়ে পুড়ে মরছে এ কথা ভাবতেও খুব আশ্চর্য লাগে! ব্যাপারটা চোখে দেখতে আরও আশ্চর্য, তাতে আর সন্দেহ কি?

আর-একটি ভয়ানক জমকালো ব্যাপারের কথা না বললে একটা মস্ত কথা বাদ থেকে যায়—সেটি হচ্ছে সূর্যের পুর্ণগ্রহণ। এ জিনিসটি যিনি একবার চোখে দেখেছেন তিনি আর কখনও ভুলতে পারেন না। যখন গ্রহণটা পূর্ণ হয়ে আসতে থাকে, চারিদিক অন্ধকারে ঘিরে ফেলে, চাঁদের প্রকাণ্ড কালো ছায়া দেখতে দেখতে চোখের সামনে পাহাড় নদী সব গ্রাস করে ছুটে আসতে থাকে—যখন বনের পশু আর আকাশের পাখি পর্যন্ত ভয়ে কেউ স্তব্ধ হয়ে থাকে কেউ চিৎকার করে আর্তনাদ করে তখন মানুষের মনটাও যে ভয়ে বিস্ময়ে কেঁপে উঠবে তাতে আর আশ্চর্য কি? বিশেষত যারা অশিক্ষিত বা অসভ্য, যাদের কাছে সূর্যের এই হঠাৎ-নিভে-যাওয়ার কোনই অর্থ নেই, তারা যে তখন পাগলের মতো অস্থির হয়ে বেড়াবে, এ ত খুবই স্বাভাবিক। তারা প্রলয় বলতে ঠিক এইরকমই একটা কিছু কল্পনা করে—এমনই একটা অদ্ভুত বিরাট গম্ভীর ব্যাপার—যার ভয়ংকর মূর্তিতে মানুষের মনকে একেবারে দমিয়ে অবশ করে দেয়।

COMMENTS

Name

Bangla Moral,3,Health,6,Humor,2,Inspiration,95,Moral Stories,18,Quote Index,7,Reading for pleasure,1,Tips and Tricks,5,গল্প - সুকুমার রায়,23,ছড়া - সুকুমার রায়,1,জীবজন্তু - সুকুমার রায়,36,বিবিধ - সুকুমার রায়,8,হাসির গল্প,2,
ltr
item
Quote Index: প্রলয়ের ভয় - সুকুমার রায়
প্রলয়ের ভয় - সুকুমার রায়
Quote Index
https://quoteindex.blogspot.com/2016/07/blog-post_37.html
https://quoteindex.blogspot.com/
http://quoteindex.blogspot.com/
http://quoteindex.blogspot.com/2016/07/blog-post_37.html
true
4124448561539239466
UTF-8
Loaded All Posts Not found any posts VIEW ALL Readmore Reply Cancel reply Delete By Home PAGES POSTS View All RECOMMENDED FOR YOU LABEL ARCHIVE SEARCH ALL POSTS Not found any post match with your request Back Home Sunday Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday Saturday Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat January February March April May June July August September October November December Jan Feb Mar Apr May Jun Jul Aug Sep Oct Nov Dec just now 1 minute ago $$1$$ minutes ago 1 hour ago $$1$$ hours ago Yesterday $$1$$ days ago $$1$$ weeks ago more than 5 weeks ago Followers Follow THIS PREMIUM CONTENT IS LOCKED STEP 1: Share to a social network STEP 2: Click the link on your social network Copy All Code Select All Code All codes were copied to your clipboard Can not copy the codes / texts, please press [CTRL]+[C] (or CMD+C with Mac) to copy Table of Content