ঘোড়ার জন্ম - সুকুমার রায়

তোমরা সকলেই জান যে এমন সময় ছিল যখন এই পৃথিবীতে মানুষ ছিল না। শুধু মানুষ কেন, জীবজন্তু গাছপালা কোথাও কিছু ছিল না। তখন এই পৃথিবী তপ্ত কড়ার মতো...

তোমরা সকলেই জান যে এমন সময় ছিল যখন এই পৃথিবীতে মানুষ ছিল না। শুধু মানুষ কেন, জীবজন্তু গাছপালা কোথাও কিছু ছিল না। তখন এই পৃথিবী তপ্ত কড়ার মতো গরম ছিল—বৃষ্টির জল তাহার উপর পড়িবামাত্র টগবগ করিয়া ফুটিয়া উঠিত। তারপর যখন পৃথিবী ক্রমে ঠাণ্ডা হইয়া আসিল, তখন তাহাতে অল্প অল্প গাছপালা জীবজন্তু দেখা দিতে লাগিল।

জীবজন্তু আসিবার অনেক হাজার হাজার বৎসর পরেও মানুষের কোন অস্তিত্ব দেখা যায় নাই। আজকাল আমরা যে-সকল জানোয়ার সচরাচর দেখিতে পাই—এগুলিও সব 'আধুনিক' কালের—অর্থাৎ সেই অতি প্রাচীনকালের জানোয়ারেরা সকলেই এখন লোপ পাইয়াছে। সকলে কিন্তু একেবারে লোপ পায় নাই; যদি পাইত তবে এখন পৃথিবীতে এসব জীবজন্তুর কিছুই দেখিতাম না। এখনকার এইসকল জানোয়ারগুলি সকলেই প্রাচীনকালের কোন না কোন জানোয়ারের বংশধর। এই যে অতি সভ্য অতি বুদ্ধিমান মানুষ, ইহার বংশের ইতিহাস যদি খুঁজিতে যাই তবে এমন জায়গায় গিয়া পড়িব যেখানে মানুষকে আর মানুষ বলিয়া চিনিবার যো থাকিবে না।

এমনিভাবে প্রত্যেক জানোয়ারের ইতিহাস যদি খুঁজিতে যাই—প্রাচীনকালের পাহাড়ের স্তরে তাহাদের যে-সকল কঙ্কালচিহ্ন পাওয়া যায়, সে সকল পরীক্ষা করিয়া দেখি—তবে প্রত্যেকের বেলায় এই কথারই প্রমাণ পাওয়া যাইবে। কিন্তু যে সকল জানোয়ার ছিল, তাহারা সকলেই ত আর আপন আপন কঙ্কালচিহ্ন রাখিয়া যায় নাই—যে-সকল কঙ্কাল পাহাড়ের মধ্যে আজও জমিয়া আছে, তাহারও অতি অল্পই মানুষের চোখে পড়িয়াছে। সেইজন্য সকল জন্তুর পূর্বপুরুষের হিসাব এখনও ভাল করিয়া পাওয়া যায় নাই। দুটা একটা যাহা পাওয়া যায় তাহা হইতেই কতকটা স্পষ্ট দেখা যায়, কতকটা অনুমান করিয়া বুঝিতে হয়, কেমন অল্পে অল্পে সে যুগের এক একটা জানোয়ার এই যুগের কুকুর বেড়াল গরু হরিণে পরিণত হাইয়াছে। পূরাতন কঙ্কাল হইতে যত জানোয়ার-বংশের প্রাচীন ইতিহাস পাওয়া গিয়াছে, তাহার মধ্যে ঘোড়ার ইতিহাস আমরা যেমন জানি এমন আর কাহারও নহে। আমেরিকার 'রকি' পাহাড়ে অনেক জানোয়ারের কঙ্কালচিহ্ন পাওয়া যায়। কয়েকজন পণ্ডিত চৌদ্দ বৎসর ক্রমাগত সন্ধান করিয়া সেখানে নানা প্রাচীন যুগের আটশত ঘোড়ার কঙ্কাল বাহির করিয়াছেন। 'ঘোড়া' বলিলাম বটে কিন্তু তাহার অনেকগুলিকেই সহজে ঘোড়া বলিয়া চিনিবার যো নাই।

সবচাইতে পুরাতন যেটি, তাহার নাম 'ইয়োহিপ্‌পাস' (Eohippus) বা 'আদি অশ্ব'। দেখিতে একটি ছোট ছাগলছানার চাইতে বড় হইবে না—পায়ে তার চারটি করিয়া আগুল বা খুর—আর একটা পঞ্চম আঙুলের চিহ্ন প্রায় লোপ পাইয়া আসিয়াছে। দেখিলে কে বলিবে যে এই জন্তুই ঘোড়ার পূর্বপুরুষ? কিন্তু সবগুলি কঙ্কাল মিলাইয়া যুগ হিসাবে পরপর সাজাইয়া দেখ, ঘোড়ার জন্মের ইতিহাস যেন চোখের সামনে স্পষ্ট দেখিতে পাইবে। ছাগলছানার মতো ছোট জন্তুটি কেমন করিয়া যুগের পর যুগ ক্রমে বড় হইল, কেমন করিয়া ক্রমে তাহার চেহারা অল্পে অল্পে বদলাইয়া আসিল, কেমন করিয়া নিত্য নূতন অবস্থার মধ্যে তাহার শরীরের নিত্য নূতন পরিবর্তন ঘটিতে ঘটিতে সেই যুগের 'আদি অশ্ব' এই যুগের আধুনিক ঘোড়ায় পরিণত হইল, তাহার জীবন্ত চিত্র পাথরের গায়ে কঙ্কালের লেখায় লিখিত রহিয়াছে। বড় হইবার সঙ্গে সঙ্গে ঘোড়ার পায়ের গড়ন মজবুত হইয়া আসিয়াছে—তাহার সমস্ত শরীরটা দ্রুত দৌড়িবার উপযোগী হইয়াছে। যে দৌড়াদৌড়ি করে, যাহাকে পরিশ্রম করিতে হয়, তাহার পক্ষে প্রচুর পরিমাণে খাদ্য গ্রহণ করা আবশ্যক হয়। সুতরাং দেহের শক্তিবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সেই পরিমাণ খাদ্য চিবাইবার উপযোগী দাঁত তাহার থাকা চাই। তাহার চোয়ালের হাড়ও ক্রমে সেইরূপ মজবুত হওয়া দরকার। এইসকল কঙ্কালের দাঁত ও মাথার হাড় পরীক্ষা করিলেও ঠিক এই কথারই প্রমাণ পাওয়া যায়।

কিন্তু সকলের চাইতে চমৎকার তাহার খুরের ইতিহাস। আদিকালের সেই পাঁচটি আঙুল কেমন করিয়া এই যুগে একটা ভোঁতা খুর হইয়া দাঁড়াইয়াছে তাহার ইতিহাস অতি সুন্দরভাবে ও স্পষ্টভাবে এইসকল কঙ্কালের মধ্যে দেখিতে পাওয়া যায়। 'আদি অশ্বের' সময়েই পাঁচ আঙুলের একটি লোপ পাইয়া আসিয়াছিল; তারপর ক্রমে আর একটি আঙুলও লোপ পাইল—বাকী রহিল তিনটি। সংখ্যায় কমিল বটে, কিন্তু মাঝের আঙুলটি ক্রমে মোটা হইয়া লুপ্ত আঙুলগুলির অভাব দূর করিয়াছে। পাশের আঙুল দুটা ক্রমেই ছোট হইয়া অনেকদিন পর্যন্ত হাড়ের টুকরার মতো পায়ের দুপাশে লাগিয়াছিল। তারপর এখনকার ঘোড়ার পায়ে ওই একটা আঙুলই সবটুকু স্থান দখল করিয়াছে—তাহাকে আর এখন আঙুল বলা যায় না।

কোন সময় হইতে মানুষ ঘোড়াকে বশ মানিতে শিখাইয়াছিল, তাহা ঠিক বলা যায় না। অতি প্রাচীন যুগের আদিম মানুষ যাহারা বনে জঙ্গলে গুহা গহ্বরে বাস করিত, তাহাদের শেষ চিহ্নের আশেপাশে লোমশ গন্ডার, অতিকায় হস্তী, খড়্গদন্ত ব্যাঘ্র ও গুহা ভল্লুক প্রভৃতি জানোয়ারের কঙ্কালচিহ্ন আজও পাওয়া যায়। ঘোড়ার ঐ তিন আঙুলওয়ালা পূর্বপুরুষের কেহ যে মানুষের কাজে লাগে নাই, তাহাই বা কে বলিতে পারে?

COMMENTS

Name

Bangla Moral,3,Health,6,Humor,2,Inspiration,95,Moral Stories,18,Quote Index,7,Reading for pleasure,1,Tips and Tricks,5,গল্প - সুকুমার রায়,23,ছড়া - সুকুমার রায়,1,জীবজন্তু - সুকুমার রায়,36,বিবিধ - সুকুমার রায়,8,হাসির গল্প,2,
ltr
item
Quote Index: ঘোড়ার জন্ম - সুকুমার রায়
ঘোড়ার জন্ম - সুকুমার রায়
Quote Index
https://quoteindex.blogspot.com/2016/07/blog-post_57.html
https://quoteindex.blogspot.com/
http://quoteindex.blogspot.com/
http://quoteindex.blogspot.com/2016/07/blog-post_57.html
true
4124448561539239466
UTF-8
Loaded All Posts Not found any posts VIEW ALL Readmore Reply Cancel reply Delete By Home PAGES POSTS View All RECOMMENDED FOR YOU LABEL ARCHIVE SEARCH ALL POSTS Not found any post match with your request Back Home Sunday Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday Saturday Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat January February March April May June July August September October November December Jan Feb Mar Apr May Jun Jul Aug Sep Oct Nov Dec just now 1 minute ago $$1$$ minutes ago 1 hour ago $$1$$ hours ago Yesterday $$1$$ days ago $$1$$ weeks ago more than 5 weeks ago Followers Follow THIS PREMIUM CONTENT IS LOCKED STEP 1: Share to a social network STEP 2: Click the link on your social network Copy All Code Select All Code All codes were copied to your clipboard Can not copy the codes / texts, please press [CTRL]+[C] (or CMD+C with Mac) to copy Table of Content