ক্লোরোফর্ম - সুকুমার রায়

আমরা মহাভারতে পড়িয়াছি, বিরাট রাজার গৃহে অজ্ঞাতবাসের শেষদিকে অর্জুন কৌরবদলের সঙ্গে যুদ্ধ করিয়াছিলেন। যুদ্ধের মধ্যে তিনি সম্মোহন অস্ত্র মারিয়া...

আমরা মহাভারতে পড়িয়াছি, বিরাট রাজার গৃহে অজ্ঞাতবাসের শেষদিকে অর্জুন কৌরবদলের সঙ্গে যুদ্ধ করিয়াছিলেন। যুদ্ধের মধ্যে তিনি সম্মোহন অস্ত্র মারিয়া শত্রুদলকে অজ্ঞান করিয়া ফেলেন। সম্মোহন অস্ত্রটা কিরূপ তাহা জানি না—কিন্তু আজকালকার ডাক্তারেরা এই বিদ্যাটি রোগীদের উপর অনেক সময়েই প্রয়োগ করিয়া থাকেন। ইহার ফলে, রোগীকে অজ্ঞান করাইয়া তাহার হাত পা কাটিয়া ফেলা হয়, অথচ রোগী তাহার কিছুই জানিতে পারে না। ব্যাপারটি অতি সহজ! রোগীর নাকের কাছে খানিকটা ঔষধ ধরিয়া তাহাকে শুঁকিতে দেওয়া হয়—রোগী সেই মিষ্ট গন্ধ শুঁকিতে শুঁকিতে বেহুঁশ হইয়া গেল। বাস্‌, তারপর চট্‌পট্‌ ছুরি চালাইয়া কাজ সারিয়া লইলেই হয়।

আফিং খাইলে বা অন্য নানারকম নেশা করিলে মানুষের জ্ঞান থাকে না। একবার একটা মাতাল নেশার ঘোরে খানায় পড়িয়া পা ভাঙিয়া ফেলে। ডাক্তার সেই নেশার অবস্থাতেইর তাহার পায়ের উপর অস্ত্র-চিকিৎসা করেন—মাতাল কিছুমাত্র বুঝিতে পারে নাই। কোন অসুখের যন্ত্রণা যখন রোগীর পক্ষে অসহ্য হইয়া পড়ে ডাক্তারেরা তখন আফিং জাতীয় ঔষধ খাওয়াইয়া তাহাকে ঘুম পাড়াইয়া রাখেন—সে ঘুমে শরীরের সমস্ত বেদনাবোধকে এমন অবশ করিয়া ফেলে যে, রোগী আর কোনরূপ যন্ত্রণা টের পায় না।

কিন্তু এরূপভাবে নেশা ধরাইয়া চিকিৎসা করার বিপদ অনেক। একে ত এইসকল ঔষধে শরীরের মধ্যে নানারূপ অনর্থ ঘটাইয়া থাকে, চিকিৎসা শেষ হইবার বহু পরেও ঔষধের নানারূপ উৎপাত চলিতে থাকে। তাহার উপর আবার ঔষধের অভ্যাস একবার ধরিয়া গেলে—তাহাতে রোগীকে একেবারে নেশার মতো পাইয়া বসে। তখন বিনা প্রয়োজনেও রোগী ঐসকল ঔষধের জন্য পাগল হইয়া উঠে—এবং ঔষধের দাস হইয়া সমস্ত জীবনটিকে মাটি করিয়া ফেলে।

১৮০০ খৃষ্টাব্দে—অর্থাৎ ১১৭ বৎসর পূর্বে হাম্‌ফ্রে ডেভি নামে একজন অসাধারণ ইংরাজ পণ্ডিত এক প্রকার 'গ্যাস' লইয়া পরীক্ষা করিতেছিলেন। ইংরাজিতে ইহাকে 'Laughing Gas' অর্থাৎ হাসাইবার গ্যাস বলা হয়। এই জিনিসটিকে নিশ্বাসের সঙ্গে টানিতে গেলে ঘাড়ে মাথায় কেমন সুর্‌সুর্‌ করিতে থাকে—তাহাতে অনেকের হাসি আসে। ডেভি দেখিলেন, শুধু সুর্‌সুর্‌ করে তাহা নয়, একটু বেশি করিয়া টানিলে মানুষ অজ্ঞান হইয়া পড়ে। এইরকমভাবে একটুখনি গ্যাস শুঁকাইয়া মানুষকে মিনিটখানেক বেশ আরামে বেহুঁশ করিয়া রাখা যায়। তাহাতে খুব দুর্বল লোকেরও কোন অনিষ্ট হইতে দেখা যায় না। ডেভি বলিলেন, "এই উপায়ে বেশ সহজেই বিনা যন্ত্রণায় ছোটখাট অস্ত্র-চিকিৎসা চলিতে পারে।" দুঃখের বিষয় সে সময়কার অস্ত্র-চিকিৎসকেরা এ কথায় কান দেন নাই! চল্লিশ বৎসর পরে একজন আমেরিকান ডাক্তার এই গ্যাসের সাহায্যে বিনা যন্ত্রণায় একটি রোগীর দাঁত তুলিয়া দেখান যে, ডেভির কথাতা নেহাৎ মিথ্যা নয়। সেই অবধি নানারূপ ছোটখাট অস্ত্র চিকিৎসায়, বিশেষত দাঁতের ডাক্তারিতে এই গ্যাসের ব্যবহার চলিয়া আসিতেছে।

কিন্তু সামান্য এক মিনিট সময়ের মধ্যে ত আর রীতিমত অস্ত্র-চিকিৎসা চলে না। সুতরাং অধিকাংশস্থলেই চিকিৎসার যন্ত্রণা দূর করিবার আর কোন উপায় ছিল না। সেই সময়কার রোগীদের কাছে অস্ত্র-চিকিৎসার মতো ভয়ানক জিনিস আর কিছু ছিল কিনা সন্দেহ। যে কয়েদীর প্রাণদণ্ড হইবে সে যেমন করিয়া ফাঁসির কথা ভাবে, রোগী তেমনি করিয়া চিকিৎসার কথা ভাবিত। কবে 'অস্ত্র করা' হইবে, সেই ভাবনায় রোগী আগে হইতেই আধমরা হইয়া থাকিত। প্রায় সকল রোগীকেই ধরিয়া বাঁধিয়া জবরদস্তি করিয়া তবে ছুরি চালাইতে হইত। এইরকম যখন অবস্থা তখন আমেরিকা হইতে সংবাদ আসিল সেখানকার এক ডাক্তার 'ইথার' অর্থাৎ সুরা জাতীয় একপ্রকার ঔষধের সাহায্যে রোগীকে বহুক্ষণ নিরাপদে অজ্ঞান রাখিবার উপায় বাহির করিয়াছেন।

জেমস্‌ সিম্‌সন্‌ নামে একটি উৎসাহী চিকিৎসক সে সময়ে এডিনবরায় চিকিৎসা করিতেছিলেন। ছাত্র অবস্থায় সেই সময়কার অস্ত্র-চিকিৎসার ভয়ানক দৃশ্য দেখিয়া সিম্‌সন্‌ এক সময়ে আরেকটু হইলেই ডাক্তারি-ব্যবসায় ছাড়িয়া দিতেন। বিনা যন্ত্রণায় চিকিৎসার কথা শুনিয়া তিনিও পরীক্ষা করিতে লাগিলেন। সিম্‌সনের কয়েকটি বন্ধুও তাঁহার সহিত যোগ দিলেন। প্রতিদিন রাত্রে কয় বন্ধু মিলিয়া যত রাজ্যের ঔষধ শুঁকিয়া শুঁকিয়া নানারূপে তাহার নিশ্বাস লইয়া দেখিতেন—ঐরকম অবসাদ আসে কিনা! এ বিষয়ে তাঁহাদের কিরূপ উৎসাহ ছিল সে সম্বন্ধে সিম্‌সনের কোন বন্ধু একটি সুন্দর গল্প লিখিয়া গিয়াছেন। ঐ বন্ধুটির বাড়িতে একটি নূতন উগ্র ঔষধ দেখিয়া সিম্‌সন্‌ তৎক্ষনাৎ জিনিসতা বিষাক্ত কি না তাহার বিচার না করিয়াই তাহা লইয়া পরীক্ষা করিতে উদ্যত হন। কিন্তু বন্ধুটি বাধা দিয়া আগে দুইটা খরগোসের উপর তাহা প্রয়োগ করেন। ফলে দুইটা খরগোসই মারা যায়।

যাহা হউক, অনেকদিন ধরিয়া অনেক পরীক্ষার পর সিম্‌সন্‌ একদিন এক শিশি ক্লোরোফর্ম আনিয়া হাজির করিলেন। সেইদিন আহারের পর দুটি বন্ধুকে সঙ্গে লইয়া তিনি পরীক্ষায় বসিলেন। ক্লোরোফর্মের শিশিতে নাক গুঁজিয়া জোরে জোরে নিশ্বাস টানিতে টানিতে তিনজনেই অজ্ঞান হইয়া পড়িলেন। যখন সিম্‌সনের জ্ঞান হইল তিনি দেখিলেন বন্ধু দুটি তখনও মোহের ঘোরে বেহুঁশ হইয়া আছেন। তিনি উৎসাহে বলিয়া উঠিলেন, "ইথারের চাইতেও চমৎকার।"

সেইদিন হইতে চিকিৎসকগণ এই সম্মোহন অস্ত্রটিকে আয়ত্ত করিতে আরম্ভ করিয়াছেন এবং তাহার ফলে অস্ত্র-চিকিৎসার বিভীষিকা সাড়ে পনর আনা পরিমাণ দূর হইয়াছে। পূর্বে যে-সকল অবস্থায় ছুরি ছোঁয়াইতে না ছোঁয়াইতে রোগী যন্ত্রনায় মারা যাইত—সেরূপ সাংঘাতিক ক্ষেত্রেও এখন আর রোগীর সে ভয়ের কারণ নাই।

COMMENTS

Name

Bangla Moral,3,Health,6,Humor,2,Inspiration,95,Moral Stories,18,Quote Index,7,Reading for pleasure,1,Tips and Tricks,5,গল্প - সুকুমার রায়,23,ছড়া - সুকুমার রায়,1,জীবজন্তু - সুকুমার রায়,36,বিবিধ - সুকুমার রায়,8,হাসির গল্প,2,
ltr
item
Quote Index: ক্লোরোফর্ম - সুকুমার রায়
ক্লোরোফর্ম - সুকুমার রায়
Quote Index
https://quoteindex.blogspot.com/2016/07/blog-post_89.html
https://quoteindex.blogspot.com/
http://quoteindex.blogspot.com/
http://quoteindex.blogspot.com/2016/07/blog-post_89.html
true
4124448561539239466
UTF-8
Loaded All Posts Not found any posts VIEW ALL Readmore Reply Cancel reply Delete By Home PAGES POSTS View All RECOMMENDED FOR YOU LABEL ARCHIVE SEARCH ALL POSTS Not found any post match with your request Back Home Sunday Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday Saturday Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat January February March April May June July August September October November December Jan Feb Mar Apr May Jun Jul Aug Sep Oct Nov Dec just now 1 minute ago $$1$$ minutes ago 1 hour ago $$1$$ hours ago Yesterday $$1$$ days ago $$1$$ weeks ago more than 5 weeks ago Followers Follow THIS PREMIUM CONTENT IS LOCKED STEP 1: Share to a social network STEP 2: Click the link on your social network Copy All Code Select All Code All codes were copied to your clipboard Can not copy the codes / texts, please press [CTRL]+[C] (or CMD+C with Mac) to copy Table of Content